Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
বিস্তারিত

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। ৪৮ বছর পূর্বে এ দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন বীরের বেশে। এ বীরের প্রত্যাবর্তনের ফলেই আমার মতো কোটি কোটি মানুষের লালিত সত্যিকারের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তার এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আসলে এ বিজয় ছিল বাংলার জনগণের। বাঙালি জাতিই সংগ্রাম করে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জয়যুক্ত করেছে, ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাকে ফিরিয়ে এনেছে। তার মুক্তির জন্য আমি দেখেছিÑ এদেশের অগণিত মানুষ রোজা রেখেছে, নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছে, মসজিদে-মন্দিরেও বিশেষ দোয়া করা হতো। কিন্তু কেন? এর একটাই কারণÑ বাঙালি জাতির আত্মার অমোঘ বাণীকে নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়েই তিনি বাঙালির হৃদয় জয় করেছিলেন। পরিণত হয়েছিলেন বাঙালির বিবেকের প্রতীকে। তার ৭ মার্চ ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদান ও মিত্র বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। 
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই বিমানে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার পরিবার। ৯ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টায় তারা পৌঁছেন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। বেলা ১০টার পর থেকে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ, টেলিফোনে কথা বলেন তাজউদ্দীন আহমদ, তার পরিবার ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্বের অনেক নেতার সঙ্গে। স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করে দিল্লিতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে দেশবাসী সবকিছু অবলোকন করছিলাম। ঢাকা শহর সেদিন লোকে লোকারণ্য। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। ওই দিন দুপুর ২টায় দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান বাংলার মাটি স্পর্শ করলে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন মুহূর্ত। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে আবেগময় চেহারায় জনগণের প্রতি অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন। তিনি প্রত্যাবর্তনের পরে আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেনÑ ‘হে কবিগুরু আপনি এসে দেখে যান, আমার সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ এত আবেগ ও এত আবেগময় দৃশ্য আর কোনো নেতার কাছ থেকেই আমি অবলোকন করিনি। আনন্দ আর বিষাদের অশ্রু দিয়ে মুক্তিপাগল বাংলার জনগণ তাকে সেদিন বরণ করে নেয়। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি ৯ মাসে বাংলার জনগণের দুঃখ-কষ্ট নির্যাতন-নিপীড়নের যে ভয়াবহ কাহিনি শুনতে পান তারপর থেকেই তিনি ছিলেন আবেগে আপুøত। অতঃপর শুরু হয় রমনা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভার উদ্দেশে যাত্রা। চতুর্দিক থেকে জনতার বাঁধভাঙা ঢল নামে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতারা একটি খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে জনতার অভিবাদন ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করছেন, আর ধীরগতিতে তাকে বহনকারী ট্রাকটি সভাস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতার ঢল ট্রাকের পেছনে পেছনে চলতে থাকে। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সে দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বাংলার জনগণের উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার থেকে আবেগঘন বক্তৃতা আর কখনও দিয়েছেন বলে আমার মনে হয় না।
সেদিন বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেনÑ ‘নেতা হিসাবে নয়, ভাই হিসাবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি, আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, সেগুলো মেরামত করতে হবে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তাদের জানি।’ বক্তৃতাদানকালে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে আসছিল। রুমাল দিয়ে তিনি চোখ মুছে নিচ্ছিলেন। জাতির পিতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও ছিল ১৮ মিনিট সময়ের, শব্দ ১১০৫।
বঙ্গবন্ধু যেদিন দেশে ফিরে এলেন, সেদিন কী অবস্থায় ছিল এ দেশ? আজ এতদিন পরে তা কল্পনা করাও এক কঠিন ব্যাপার। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। হাটবাজার, রাস্তাঘাট, রেল ব্রিজ, বন্দরÑ সব ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সূম্পর্ণ বিচ্ছিন্ন। বৈদেশিক মুদ্রা বলতে কিছুই ছিল না। গ্রাম-বাংলার ধু-ধু প্রান্তর ছিল শস্যহীন। খাদ্যগুদামে কোনো মজুত ছিল না। শহরের ঘরবাড়ি শিল্পকারখানা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে হানাদার বাহিনী ছারখার করে দিয়েছিল। ৩০ লাখ বাঙালির শহীদ হওয়ার কারণে প্রতিটি গৃহে ছিল আর্তনাদ। সন্তান-স্বামী, বাবা-মা হারানোর বেদনায় প্রতিটি পরিবার ছিল শোকাহত। তবু রয়েছে দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিপুল অস্ত্রপাতি, আর দেশের মাটিতে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য, যাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও বিদেশি স্বীকৃতি লাভের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন পুনরুদ্ধারের কাজ। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় তিনি দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সফল করেন। স্বাধীনতার পরপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ বিদেশনীতি স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে আমাদের পক্ষে আনতে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম উম্মাহর অনেক দেশ, যারা পাকিস্তান ভাঙার কারণে বেশ কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি দেশে ফিরে না এলে অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছিলেন বলেই ভারতীয় সৈন্য অতি দ্রুত সময়ে প্রত্যাবর্তন করেছিল। পৃথিবীর কোনো দেশের স্বাধীনতার পর এত কম সময়ে মিত্র শক্তি সহজে দেশ ছাড়ে না। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু তখন ফিরে না এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র এত তাড়াতাড়ি জমা পড়ত না এবং রাজাকার, দালালদের নিয়ে সম্ভবত এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।
মুক্তিযোদ্ধারা ও জনগণ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে, দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অভিভাবকত্বে একটি শান্তিময় বিচারিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যে কারণে মারাত্মক অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয় এবং তাতে জনগণের মনে কিছুটা হলেও স্থিরতা আসে। পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তিদের প্রতি তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। হায়রে বাঙালি এ মহান হৃদয়বান বাঙালি, সিংহ হৃদয় জাতির পিতার প্রতি এ কী আচরণ করলে তোমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট? মহাত্মা গান্ধী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি করে তোমরা আবারও নাথুরাম গডসে ও মীরজাফর উপাধি ধারণ করলে? ধিক তোমাদের! ইতিহাস তোমাদের ক্ষমা করবে না। এখনও মানুষ হও, মানবিক হও মীরজাফরেরা।
সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু তখন ফিরে না এলে মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন এবং সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পথে জাতির অগ্রযাত্রা সম্ভব হতো না। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন এদেশের কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র ও মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। সোনার বাংলা গড়ার জন্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তার সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে।
হে বাঙালি জাতি জাগ্রত হও, সচেতন হও, একটি সুশিক্ষিত, সুনীতিসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, মানবিক ও সুশৃঙ্খল উন্নত স্বনির্ভর জাতিতে রূপান্তরিত হও। তবেই বঙ্গবন্ধুর, তার পরিবারের, ৩০ লাখ শহীদের ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ও শ্রমের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবন থেকে প্রেরণা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চির অমøান হয়ে থাকবে। হ

ডাউনলোড
প্রকাশের তারিখ
11/01/2020